নির্যাতনের শিকার আবারো সেই সংখ্যালঘুরাই

হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে, ঢাকা: বাংলাদেশে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা থামছে না৷ ভোট-বিরোধীরা যেমন সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছেন, তেমনি পিছিয়ে নেই আওয়ামী লীগও৷ এ সব সহিংসতার প্রধান টার্গেট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ৷ যার জন্য পরস্পরকে দায়ী করছে সরকার ও বিরোধীদল৷

রবিবারের একতরফা নির্বাচনের পর বাংলাদেশের যশোর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, চট্টগ্রাম, মাগুরা এবং সাতক্ষীরায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চলে৷ দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে পুড়ে যায় সংখ্যালঘুদের কয়েকশ’ বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান৷ অনেকেই এরপর নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান প্রাণ ভয়ে৷

দিনাজপুরের সদর উপজেলার একটি গ্রামে নির্বাচনের পর নির্বাচন বিরোধীরা সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট ও ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়৷ চলে ভাঙচুর, দেয়া হয় আগুন৷ সেখানকার শতাধিক সংখ্যালঘু পরিবার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় পাশের কর্ণাই গ্রামে কয়েকটি বাড়িতে৷

যশোরের অভয় নগরের চাপাতলা গ্রামের মালোপাড়াতেও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে নির্বাচনের পর পর৷ নির্বাচন বিরোধীরা অর্ধশতাধিক বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়ে লুটপাট করে৷ এরপর বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা৷ শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, ঐ এলাকার সংখ্যালঘুরা সর্বস্ব হারিয়ে এখন খোলা আকাশের নীচে আশ্রয় নিয়েছেন৷

মাগুরার বাটাজের গ্রামে নির্বাচন বিরোধীরা হামলা চালিয়ে ঘর-বাড়ি ছাড়াও পানের বরজ পুড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গছে৷ এছাড়া ঠাকুরগাঁও, সাতক্ষীরা এবং চট্টগ্রামে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ সাতক্ষীরার সংখ্যালঘুরা বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিরপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে৷

যশোরের সাংবাদিক সাজেদ রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, নির্বাচনের পর অভয় নগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হলে নারী-পুরুষ ও শিশুরা ভৈরব নদী সাঁতরে পাশের গ্রামে আশ্রয় নেন৷ এরপর সেখানে প্রশাসন ও পুলিশ গেলেও তাঁরা নিজ গ্রামে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন৷ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের কিছু সহায়তা দেয়া হলেও সেখানকার নব নির্বাচিত সংসদ সদস্য রণজিত রায় ক্ষতিগ্রস্থদের দেখতে যাননি৷ মঙ্গলবার সরেজমিন পরিদর্শন করে সাজেদ রহমান জানান, পুরো অভয় নগরে এখন ভীতিকর পরিস্থতি বিরাজ করছে৷ ক্ষতিগ্রস্থরা তাঁকে জানিয়েছেন যে, তাঁদের ভোট দিতে বারণ করা হয়েছিল৷ আর সেই বারণ না শোনাতেই তাঁদের ওপর হামলা হয়েছে৷

ওদিকে দিনাজপুরের সাংবাদিক খাদেমুল ইসলাম মঙ্গলবার দিনাজপুর সদরের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ডয়চে ভেলেকে জানান, সেখানে প্রশাসন এখন ত্রাণ সহায়তা দিলেও সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি৷ তাঁরা খোলা আকাশে নীচে পুলিশ পাহারায় অবস্থান করছেন৷ আশেপাশের গ্রামের সংখ্যালঘুরাও চরম আতঙ্কে আছেন৷ ভয়ে কেউ স্কুলেও যাচ্ছে না৷ তবে খাদেমুল ইসলাম জানান, এ পর্যন্ত হামলার ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে৷ গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটিও৷

এদিকে দেশের কমপক্ষে ১৫টি জেলায় নির্বাচন পরবর্তী শতাধিক সহিংস ঘটনায় অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন৷ ঢাকার দোহার উপজেলায় নির্বাচনে পরাজিত পক্ষ বিজয়ী পক্ষের ওপর হামলা চালিয়ে তিনজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে৷ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান পরাজিত হয়েছেন৷ জয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী নির্বাচনকালীন সরকারের প্রতিমন্ত্রী সালমা ইসলাম৷

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার জন্য সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরকে দায়ী করছে৷ তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের৷ সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হবে, তাঁদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হবে আর সরকার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে – তা হয় না৷ সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে৷ অপরাধীদের প্রতিরোধ এবং আক্রমণ বন্ধে সরকারকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে৷

তিনি বলেন, সংখ্যালঘুরা এখন এক ভীতিকর পরিবশের মধ্যে আছেন৷ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে এ সব হামলার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা হচ্ছে৷ কিন্তু সরকারকে তা গভীরভাবে তদন্ত করে দেখতে হবে৷ তার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতকেও জবাবদিহি করতে হবে৷

অন্যদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন বাংলাদেশে চলমান সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷ তিনি বলেছেন, জনগণ ও তাঁদের সম্পদের ওপর হামলা এবং সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না৷ তাই একটি অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের জন্য সংলাপ শুরুর তাগিদ দিয়েছেন তিনি৷

কৃতজ্ঞতা: প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে সংগৃহীত

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on email

Facebook Page

Subscribe Please