মাইনোরিটি ওয়াচ
বিবিসি বাংলা “হিন্দুরা নয়, অগাস্টের পরে বাংলাদেশ থেকে বেশি সংখ্যায় ভারতে গেছেন মুসলিমরাই” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গত ১ জানুয়ারী প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক অত্যাচারের তথ্যকে তুচ্ছ করে দেখানোর প্রয়াস স্পষ্ট।
প্রতিবেদনে বিবিসি বলেছে: “এ বছর অগাস্ট থেকে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করতে গিয়ে যতজন বাংলাদেশি নাগরিক ধরা পড়েছেন, তাদের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যাই বেশি বলে জানাচ্ছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ।”
হিন্দু ৩০১, মুসলমান ৪১৫
বিবিসি বলেছে, “বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলের সূত্রে যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে এ বছরের অগাস্ট মাস থেকে ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ পর্যন্ত ৭১৬ জন বাংলাদেশি নাগরিক অবৈধ ভাবে সীমান্ত পেরোতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের হাতে ধরা পড়েছেন। এদের ধর্মীয় পরিচয় থেকে জানা যাচ্ছে যে, তাদের মধ্যে ৩০১ জন হিন্দু এবং ৪১৫ জন মুসলমান।”
এই তথ্য ধরে প্রতিবেদনটি উপস্থাপনের সময় বিবিসি বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যার আনুপাতিক হারকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে হিন্দু কত শতাংশ?
২০২২ সালের সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যার মাত্র ৭.৯৫ শতাংশ হিন্দু। এই অনুপাত অনুযায়ী ভারতে বিএসএফের হাতে আটক ৭১৬ জনের মধ্যে হিন্দু থাকার কথা বড় জোর ৫৭ জন। বাকি ৬৫৯ জন অনুপ্রবেশকারী হওয়ার কথা মুসলমান। তাহলে দেশ ছেড়ে কারা বেশি সংখ্যায় সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে? বাংলাদেশে যারা সংখ্যালঘু।
কী কারণে এই মানুষগুলো তাদের পুর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে জীবন ও জীবিকার চুড়ান্ত ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে তা সহজেই বোঝা যায়। বিবিসির প্রতিবেদনে কারণগুলো সুস্পষ্ট না করে বরং মুখ্য কারণকে কেন যেন অস্বীকার করা হয়েছে।
বিবিসি এর আগে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনকে ‘গুজব’ আখ্যা দিয়ে এক বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ কর্তপক্ষকে হিন্দুদের উপর নির্যাতন অস্বীকার করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। বিবিসি’র সে প্রতিবেদনটি ছিল উদ্দেশ্যমূলক ও তথ্যগোপন করার খেলা।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দুরা ছাড়াও বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের পর সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের উপর ভয়াবহ অত্যাচার চালানো হচ্ছে। সরকারের বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার, গণহারে হত্যা-মামলা দায়ের, বাড়িঘরে আগুন দেয়া, লুটপাট. গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
এ অবস্থায় বিপুল সংখ্যক মানুষ আত্মরক্ষার জন্য গা ঢাকা দিয়েছে এবং অনেকে সীমান্ত পারি দিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে ভারতে ধরা পরা মাত্র ৪১৫ জন মুসলমানকে বেশি বলার সুযোগ নেই।
ধরা না পরে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে ভারতে পারি জমানো বাংলাদেশীর প্রকৃত সংখ্যা বিবিসি প্রকাশ করতে পারেনি।
তবুও অজ্ঞাত কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বিবিসি বলেছে, “পুরো বছরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যাবে অগাস্ট থেকে ডিসেম্বরের সময়কালে অনুপ্রবেশের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য কোনও বদল ঘটেনি। হিন্দু এবং সব ধরনের অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা সামান্যই বেড়েছে।”
প্রতিবেদন অনুযায়ী, “বিগত দুই বছরের অগাস্ট থেকে ডিসেম্বর সময়কালে ধরা পড়া অনুপ্রবেশকারীদের পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে ২০৩ জন হিন্দু এবং ৪৪৯ জন মুসলমান ধরা পড়েছিলেন দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলে। আবার তার আগের বছর, ২০২২ সালে অগাস্ট থেকে ডিসেম্বরে ১১৪ জন হিন্দু এবং ২৯৮ জন মুসলিম অবৈধ ভাবে ভারতে প্রবেশ করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন।”
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতনকে বাস্তব হিসেবে গ্রহণ করেনি বিবিসি। তারা একে “কথিত নির্যাতন” হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে।
লিখেছে, “বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপরে কথিত নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই সরব ভারতীয় সংগঠন ‘ক্যাম্ব’-এর আহ্বায়ক মোহিত রায় বিবিসিকে জানাচ্ছিলেন, “চিরকালই বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যাই বেশি থাকে।”
নাম উল্লেখ না করে বিএসএফের বায়বীয় সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি বলেছে, “বাংলাদেশে তাদের ওপরে নির্যাতন বা অত্যাচার হয়েছে বা হওয়ার আশঙ্কা করছেন, এবং সেই কারণেই তারা ভারতে চলে এসেছেন, এমন হিন্দু অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।”
তবে তারা স্বীকার করেছেন, “ধৃত অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা থেকে এই উপসংহার টানা যায় না যে শুধুমাত্র ওপরে উল্লেখিত সংখ্যক মানুষই কেবল অনুপ্রবেশ করেছেন।” কারণ “অনেক অনুপ্রবেশকারী সীমান্ত রক্ষীদের হাতে ধরা না পড়েও ভারতে প্রবেশ করতে সক্ষম হন।”
উল্লেখ্য, ২০২৪ এর আগস্টে রাজনৈতিক পালাবদলের পর আক্রান্ত শত শত হিন্দু আত্মরক্ষার তাগিদে ভারতে যাওয়ার জন্য সীমান্তে জড়ো হয়েছিল। এ বিষয়টি বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো গোপন করলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ভিডিও চিত্রসহ সংবাদ প্রকাশ করেছিল। এরকম কয়েকটি প্রতিবেদনের লিংক নিচে যুক্ত করছি। বিবিসির আলোচ্য প্রতিবেদনটি উক্ত সকল প্রতিবেদনের তথ্য আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা বলে প্রতীয়মান হয়।
পড়ুন:
-
ভারতে প্রবেশের চেষ্টায় শয়ে শয়ে বাংলাদেশী: এশিয়ানেট
-
Hindus in Bangladesh try to flee to India amid violence: Reuters
-
Bangladeshi Hindus still waiting to cross into India: DW
-
Hundreds of Bangladeshi Hindus try to cross into India: AFP
-
BSF sends back 1,000 men, mostly Hindus at India-Bangladesh border in Cooch Behar district: PTI
-
Hundreds of Bangladeshi Hindus try to cross into India: Arab News