মান্দি নৃত্যকলার সৌন্দর্যের খোঁজে

মান্দি নৃত্যকলার সৌন্দর্যের খোঁজে

পরাগ রিছিল: কাহিনিটি খুব প্রাচীনকালের…। কীভাবে নাচতে হয়, মান্দিদের কাছে তখনো তা ছিল অজানা। রিকমা নামের এক মহিলার সাত ছেলে। তাদের গোয়ালভরা গরু। রাখাল সেজে গরু রাখতে সাত ভাই চলে যেত দূর-দূরান্তে, গোচারণ ভূমিতে। সেখানে ছিল একটি বড়ো বটগাছ। সেই বটগাছের ছায়ায় বসতো তারা। গরুর পাল ছেড়ে দিয়ে অবসরে বাজাত বাঁশ দিয়ে তৈরি দিমচ্রাং।

গোচারণ ভূমির অদূরে বসবাস ছিল এক পরিবারের। সে পরিবারে সাত কন্যা। তারা কখনো ঢেঁকিতে ধান ভানত। একদিন ঢেঁকিতে ধান ভানার সময় দিমচ্রাংয়ের সুর শুনে তাদের মন হয়ে ওঠে উতলা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সুরের উত্সস্থলের দিকে এগোল সাত বোন। সেখানে গিয়ে দেখতে পেল, সাত ভাই সৃষ্টি করছে অপূর্ব সেই সুরের মূর্ছনা। সেই সুর ছড়িয়ে পড়ছে গাছ, পাতা, নদী, বন, প্রকৃতি জুড়ে।

তাদের খুব নাচতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু নাচবে কীভাবে? নাচের উপায় যে তখনো অজানা! সাত ভাই তখন তাদের পানকৌড়িদের দেখাল। তারা দেখতে পেল, পানকৌড়ি কখনো ডানা ঝাপটাচ্ছে, কখনো বা ডানা মেলে উড়ছে। সাত ভাই তাদেরকেও পানকৌড়ির মতো দু’বাহু প্রসারিত করতে বলল। কোমর দুলিয়ে কখনো নিচে নামতে আবার দোলাতে দোলাতে ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠতে বলল। গাছ বেয়ে পোকা যেভাবে এঁকেবেঁকে ওপরে উঠে যায় সেভাবে কোমর দোলাতে বলল। লাফিয়ে পা একবার ডানে আরেকবার বামে নিতে বলল।

সাত বোন হাসে, যেনবা তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না! অমন করলেই সুন্দর নাচ হয়ে যাবে? সাত ভাই দিমচ্রাং দিয়ে সুরের মূর্ছনা তৈরি করে। প্রথমদিকে নাচতে কিছুটা সমস্যা হলেও কিছুক্ষণ পর সাবলীল হয়ে এল। সাত বোন সব ভুলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচতে লাগল।

তাদের সেই অভূতপূর্ব নাচে ধরণীর গাছ, পাতা, নদী, বন আন্দোলিত হলো; আন্দোলিত হলো পাহাড়, প্রকৃতি।

মান্দিদের দোয়াল গোত্রের মিথ অনুসারে মান্দিরা এভাবেই প্রথম পানকৌড়ির কাছ থেকে নাচতে শিখেছিল।

জুম নৃত্য

মান্দিদের প্রধান উৎসব ওয়ানগালায় জুম নৃত্য প্রায়শই পরিবেশিত হতে দেখা যায়। জনপ্রিয় এই জুম নৃত্যকে জুমচাষকেন্দ্রিক আচারের একটি ফুল প্যাকেজ বলা যায়, যেখানে জুম চাষের শুরু থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়কে ধাপে ধাপে নাচের মাধ্যমে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলা হয়। প্রথমে সারি বেঁধে একদল তরুণী দামার দ্রুতলয়ের তালে দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে এক স্থানে গোল হয়ে বসে, তারপর সব আঙুল দ্রুত নাড়াতে নাড়াতে ওপরের দিকে উঠে দাঁড়াতে থাকে; যা জুম জমিনের জঙ্গল পোড়ানোর চিহ্ন। তারপর সরু একটি লাঠি দিয়ে প্রথমে একজন তরুণ কোমর থেকে ডানদিকে সামান্য বেঁকে গিয়ে বামপাশে নিচের দিকে সজোরে আঘাত করে। তারপর বাম থেকে ডানদিকে, যা জুমের বীজ বপনের জন্য গর্ত খোঁড়াকে নির্দেশ করে। পেছনে এক তরুণী মুঠোধরা ডান হাত থেকে কিছু বীজ সেই গর্তে ফেলে দেবে এবং ডান পা নাড়িয়ে সেই গর্ত মাটি দিয়ে ভরে দেবে। বাম হাতের মুঠো থেকে বীজ ফেললে মাটি ভরিয়ে দেবে বাম পায়ে। কাজ থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে তরুণী দল একত্রে ঝরনার পাশে বসে দু’হাতে আঁজলায় জল ভরে একবার ডান কাঁধে, আরেকবার বাম কাঁধের দিকে জল ঢালবে। গা ভিজিয়ে গোসল সেরে, শরীর থেকে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করবে।

তারপর ফসল তোলার সময় এলে তরুণীরা মাথায় বাঁধা খক বা খকখ্রেং কাঁধে ঝুলিয়ে একবার ডান হাত দিয়ে জুম ফসলের ধান সংগ্রহ করে পেছনের খকখ্রেং বা ফসল রাখার ঝুড়িতে রাখবে। পরের বার একই কায়দায় বাম হাত দিয়ে ফসল রাখবে। ফসল তোলা শেষ হলে, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, গ্রামের সবাই মিলে সেই ফসল পাবার আনন্দে ওয়ানগালা উত্সবে মেতে উঠবে।

কালের বিবর্তনে আজ যদিও জুম ফসলের চাষ মান্দি সমাজ থেকে উঠে গেছে তবুও তো পূর্বমানুষের আনন্দস্মৃতি অম্লান হয়ে আছে! ব্রিটিশ আমলে বনবিভাগ সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করলে মান্দি অঞ্চলে জুম চাষ বন্ধ হয়ে যায়।

চাম্বিল মে’সা

এই নাচে কোনো পুরুষ বা তরুণ গামছার একপাশ শক্ত করে কোমরে বেঁধে নেয়। আরেকপাশ পেছনের দিকে বানরের লেজের মতো লম্বা করে ঝুলিয়ে অপর মাথায় বনের চাম্বিল ফল, যা আকারে দেখতে অনেকটা বাতাবি লেবু বা কদবেলের মতো; বেঁধে নেয়। তারপর ডান হাতে চাম্বিল ফলটি মুঠো করে ধরে ডান পাশ থেকে নিচের দিকে সজোরে ছোড়ে যাতে গামছার শক্ত টানে সেটি ঘুরতে থাকে। সেই ঘূর্ণনের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে কোমর দোলাতে থাকে। কখনো এক পা সরিয়ে ধীরে অপর পা সেদিকে নিয়ে স্থান পরিবর্তন করে, আবার কখনোবা দু’ পায়ে একত্রে লাফিয়ে বানরের মতো নাচতে থাকে। এই চাম্বিল মে’সা বা বানর নৃত্য দর্শকের মনে প্রচুর আনন্দের খোরাক জোগায়।

দখ্রু সু’য়া

দখ্রু শব্দের অর্থ হচ্ছে ঘুঘু পাখি। ঘুঘু পাখি যেভাবে উড়ে এসে ধান বা খাবার খুটে খায়, দখ্রু সু’য়া নৃত্যে সেই ভঙ্গিমাটি প্রদর্শিত হয়।

দ’সিক মিগারু চাআ : আচিক ভাষায় দ’সিক শব্দের অর্থ টিয়া পাখি আর মিগারু শব্দের অর্থ যব। দ’সিক মিগারু চাআ নৃত্যে টিয়া পাখি উড়ে এসে যেভাবে যব খায়, তা দেখানো হয়। তরুণ নাচিয়েরা দামার তালে টিয়া পাখির মতো ঠোকর দেবার ভঙ্গি করে, তরুণীরা তখন পিছু হটে, কিছুক্ষণ পর আবার সামনে আসে; ঠোকর দেবার ভঙ্গি করলে আবারও পেছনে সরে যায়।

আমব্রেত খল্লা

আমড়াকে মান্দি বা গারোদের আচিক ভাষায় বলা হয় আমব্রেত। এই নাচে মাঝখানে একটি বাঁশের খুঁটি থাকে। বাঁশের খুঁটিকে ঘিরে তরুণ-তরুণীরা নাচে। বাদ্যের তালে তালে কখনোবা নিচু হয়ে বসে। আমড়া কুড়োনোর ভঙ্গি করে নিজেদের আঁচলে রেখে দেয়।

স্মরণাতীতকাল থেকেই মান্দিরা প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে বসবাস করে আসছে। প্রকৃতির কোলে থাকতেই তাদের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ। আবিমানি গারো রাজা বলে পরিচিত পরেশ চন্দ্র মৃ যথার্থই বলেছেন, ‘আমরা বনের সন্তান। বনে আমাদের জন্ম। আমরা বনেই বেড়ে উঠেছি। এই বন জীবনে আমরা এতটাই অভ্যস্ত যে, এখান থেকে উচ্ছেদ করলে আমরা বাঁচতে পারব না।’ মান্দিদের নৃত্যকলায়ও আমরা তাই দেখতে পাই প্রকৃতির সাথে নিবিড় সংযোগ। বনের পাখিদের কাছ থেকে এসেছে মান্দি নৃত্যের অনেক মুদ্রা। নির্জন নিরিবিলিতে বসবাস করা ঘুঘুর প্রভাব, মান্দি জীবন-মান্দি নৃত্যে। এসবই মান্দি নৃত্যকলার স্বকীয় সৌর্ন্দয।

তথ্যসূত্র :দাওয়ালী মতেন্দ্র মানখিন, জানিরা, ২য় সংখ্যা।

গারোদের সমাজ ও সংস্কৃতি, সুভাষ জেংচাম।

স্বীকৃতি: প্রতিবেদনটি [এই লিংক থেকে ] গুগল নিউজ ফিডের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের ওয়েবসাইটে পোস্ট হয়েছে। মাইনোরিটি ওয়াচ এই লেখা সম্পাদনা করেনি। এই লেখার সকল তথ্য, উপাত্ত, দায়িত্ব এবং কৃতিত্ব এর রচয়িতার। 

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on email

Facebook Page

Subscribe Please