বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে
সংবাদ সম্মেলন
তারিখ: ৩০ জানুয়ারী, ২০২৫
সময়: সকাল ১১টা
স্থান: আব্দুস সালাম হল, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা
⇒Click here for the English version of the HBCUC statement.
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
ধর্মীয় বৈষম্যবিরোধী মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিবাদন। কৃতজ্ঞতা জানাই আজকের এ সংবাদ সম্মেলনে আপনাদের সহৃদয় উপস্থিতির জন্যে।
আজকের এ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আপনাদের সহযোগিতায় দেশবাসী, সকল রাজনৈতিক দল ও নাগরিক নেতৃবৃন্দ এবং সরকারের সহৃদয় অবগতি এবং সক্রিয় পদক্ষেপ কামনায় কয়েকটি বিষয় লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে আমরা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি।
আজকের উপস্থাপিত বিষয়সমূহ হল- ১) চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, ২) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের বৈষম্যমূলক আচরণ, ৩) অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ, ৪) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব ও অংশীদারিত্ব, ৫) ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে হয়রানীমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের, ৬) দলিত ও ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠীর জন্যে রাষ্ট্রের বিশেষ উদ্যোগ এবং ৭) সংখ্যালঘুদের ৮ দফা দাবির বাস্তবায়ন।
♦ চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সারা দেশব্যাপী ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতা চালানো হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে গত ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গত ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট, ২০২৪ পর্যন্ত সারা দেশব্যাপী সংঘটিত ২০১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার চালচিত্রসম্বলিত তালিকা এবং একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয় আপনাদের সহযোগিতায় দেশবাসী, রাজনৈতিক দলসমূহ ও নাগরিক নেতৃবৃন্দ এবং সরকারের সহৃদয় অবগতির জন্যে। উক্ত সংবাদ সম্মেলনে অনতিবিলম্বে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ, এর সাথে জড়িত দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় এনে গ্রেফতার এবং বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জোর দাবি জানানো হয়।
আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, সরকারের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সম্পর্কিত ঘটনাবলীকে কোনপ্রকার গুরুত্ব না দিয়ে ঐক্য পরিষদের উত্থাপিত রিপোর্ট মিথ্যা, অতিরঞ্জিত ও বানোয়াট বলে অস্বীকার করার কৌশল নেয়া হয়। কিন্তু আপনাদের ঐকান্তিক সহায়তায় দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম উক্ত রিপোর্টে উল্লেখিত সহিংসতার ঘটনার উপর বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এবং দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘ মানবাধিকার সংগঠন এবং পার্লামেন্ট ও সরকারের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাবলীকে বিভিন্নভাবে তুলে ধরার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বীকার করেন যে, বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং তা বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ইতোমধ্যে ৮৮টি মামলায় ৭০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পরবর্তীতে গত ১১ জানুয়ারি, ২০২৫ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং পুলিশের অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে জানান যে, ঐক্য পরিষদ কর্তৃক আনীত অভিযোগের ২০১০টি ঘটনার মধ্যে ১৭৬৯টি হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে এর মধ্যে ১৪১৫টি অনুসন্ধান করেছে ও বাকি ৩৫৪টির অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ৬২টি মামলা দায়ের এবং ৯৫১টি সাধারণ ডায়েরী করা হয়েছে ও ৩৫ জন অপরাধীকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানায়। প্রেস উইং আরো বলে, পুলিশী তদন্তমতে ১৭৬৯টি ঘটনার মধ্যে ১২৩৪টি ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ২০টি ঘটনা সাম্প্রদায়িক।
চলমান সহিংসতাকে যে যেভাবেই ব্যাখ্যা দিক না কেন ঐক্য পরিষদ মনে করে, গত ৪ আগস্ট থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে তাদের বাড়িঘর, উপাসনালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত সকল হামলা, ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ, হত্যা ও জোরপূর্বক নিরব চাঁদাবাজিসহ যাবতীয় অপরাধের শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এ ধরণের সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনা শুধু ফৌজদারী অপরাধই নয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধেও অপরাধ এবং তা এখনও চলমান।
২০ আগস্ট, ২০২৪ পরবর্তীতে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ২১ আগস্ট, ২০২৪ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে গ্রামীণ পর্যায়ে মোট ১৭৪টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে এমনও সহিংসতার ঘটনা রয়েছে যেখানে একই ঘটনায় একাধিক পরিবার আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ক্রমিক নং | সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ধরণ | ঘটনার সংখ্যা |
---|---|---|
১. | হত্যা- | ২৩ |
২. | নারী নির্যাতন/ধর্ষণ/গণধর্ষণ- | ৯ |
৩. | উপাসনালয়ে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ- | ৬৪ |
৪. | কথিত ধর্মঅবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার ও নির্যাতন- | ১৫ |
৫. | বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ- | ৩৮ |
৬. | জোরপূর্বক বাড়িঘর, জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল- | ২৫ |
মোট- | ১৭৪ |
সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী নির্বিশেষে দৈহিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সারা দেশব্যাপী চলমান ঘটনায় বাংলাদেশের আপামর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ট্রমার মধ্যে দিনাতিপাত
করছে। সরকারের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে অস্বীকার করা এবং প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় না আনার কারণে সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে আরো হুমকির মুখে পড়েছে, পড়ছে আপামর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী।
আমরা মনে করি, উপরোল্লিখিত তথ্যাদি সার্বিক ঘটনাবলীর আংশিক চিত্রমাত্র। কেননা, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখের সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থাপিত তথ্যসমূহ সংগ্রহ করা হয়েছিল ঐক্য পরিষদের সারাদেশের শাখা সংগঠনগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু এবারে তা সম্ভব হয়নি। কারণ, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিদ্যমান বাস্তবতায় অব্যাহত হুমকি-হামলা এবং মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমায় জড়িত হবার কারণে তাদের পক্ষে মাঠ থেকে তথ্যাবলী সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
আমরা আরো উল্লেখ করতে চাই যে, জাতিগত সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতাও ক্রমশই বাড়ছে। গত ১৫ জানুয়ারি আদিবাসী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রক্ষা ও আদিবাসী হিসেবে তাদের পরিচয়ের দাবিসহ নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চিত্রকর্ম বা গ্রাফিতি বাদ দেয়ার প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে গেলে চিহ্নিত একটি গোষ্ঠী তাদের উপর সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। আদিবাসী শিক্ষার্থী ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ অনেকেই এতে গুরুতরভাবে আহত হন। এদের মধ্যে অনেকে এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য, ঘটনার সাথে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের অনেকেই এখনো গ্রেফতার হয়নি, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সাম্প্রদায়িক ও মানবতাবিরোধী এ সকল সহিংসতার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে। অনতিবিলম্বে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্যে সরকারের কাছে পুনরায় জোর দাবি জানাচ্ছে। বিচারহীনতার রাজনীতি এবং সংস্কৃতি বন্ধ করে দশকের পর দশক ধরে চলা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার সংখ্যালঘুদের জন্য ন্যায়বিচার আজ নিশ্চিত করার সময় এসেছে।
♦ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের বৈষম্যমূলক আচরণ
প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,
আমরা লক্ষ্য করছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করেছে, যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত সরকারের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্খিত। প্রথমতঃ মব জাস্টিসের নামে এ বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয়েছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সংখ্যালঘু শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে। এর শিকার অনেক শিক্ষক আজও তাদের প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে যেতে পারেননি। পরিস্থিতি তাদের অনেককেই পরিবার-পরিজনসহ মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য করছে।
আজকের এ সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করতে চাই, ৪০তম ক্যাডেট সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) পদে চাকুরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত ৮০৪ জন সাব ইন্সপেক্টর সারদা পুলিশ একাডেমীতে প্রশিক্ষণকালে কথিত শৃংখলাভঙ্গের ঠুনকো অভিযোগ এনে গত ২১ অক্টোবর ২০২৪ থেকে ৪ ধাপে ৩২১ জনকে চাকুরী থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
প্রশিক্ষণরত ৮০৪ জনের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিল ১৭৫ জন যা মোট প্রশিক্ষণার্থীর ২১.৭৭%। অব্যাহতি পাওয়া ৩২১ জন প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ১০৩ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। যা মোট অব্যাহতিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩২.০৯% এবং মোট প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ১২.৮১%। অর্থাৎ মোট প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২১.৭৭% থেকে (১৭৫-১০৩ = ৭২ নিয়োগপ্রাপ্ত) ৮.৯৬% নামিয়ে নেয়া হয়েছে। ৫৫ জন নারী কর্মকর্তার মধ্যে ৩৩ জন অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অব্যাহতিপ্রাপ্ত নারী কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৬ জনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, যা মোট অব্যাহতির ৪৮.৪৮%। যাদেরকে অব্যাহিত দেয়া হয়েছে তাদেরকে যথাযথ বিধি অনুসরণ করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়নি বলে জানা যায়। আমরা মনে করি, এ ধরনের প্রক্রিয়া বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও বিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
আমরা আরো লক্ষ্য করলাম, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে ৪০তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে শিক্ষানবিশ সহকারী পুলিশ সুপারদের প্রশিক্ষণকালীন সময়ে ৬৬ জনের মধ্য থেকে ২৫ জনকে অজানা কারণে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। পরবর্তীতে ২১ জনকে বাদ দেয়া হয় যার মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৯ জন।
১৫ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে ৪৩ তম বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ২০৬৪ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে সরকারি কর্মকমিশন কর্তৃক উত্তীর্ণ ঘোষিত ২১৬৩ প্রার্থীর মধ্যে মোট ২৬৭ (সাময়িক অনুপযুক্ত ২২৭ জন + স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত ৪০ জন) জনকে বাদ দিয়ে ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে ১৮৯৬ জনকে উপযুক্ত ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ ৪৩তম বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীদের গোয়েন্দা বিভাগ কর্তৃক যাচাই-র নামে ২২৭ জনকে বাদ দেয়া হয়। বাদ পড়াদের মধ্যে ৮২ জনই ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, যা মোট বাদ পড়া ৩৬.১২%। সহকারী কমিশনার (প্রশাসন) পদে বাদপড়া ২৬ জনের মধ্যে ১৪ জনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, যা মোট বাদপড়া ৫৩.৮৪%। সহকারী সচিব (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) পদে বাদপড়া ৩ জনে মধ্যে ৩ জনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যা ১০০%। সহকারী কর কমিশনারের ক্ষেত্রে বাদপড়া ৭ জনের মধ্যে ৫ জনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বাদপড়ার হার ৭১.৪২%। সহকারী কমিশনার (শুল্ক ও আবগারি) যে ১ জন যোগ্য বিবেচিত হয়েছিল তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। একইভাবে সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে ১৫ অক্টোবরের সার্কুলারে উল্লেখিত ২জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রার্থীর নাম ৩০ ডিসেম্বরের সার্কুলারে হারিয়ে গেছে। অনুরূপভাবে প্রভাষক (সমাজবিজ্ঞান) পদে বাদ দেয়া ৫ জনের মধ্যে ৫ জন এবং প্রভাষক (ইংরেজী) পদে বাদ পড়া ৮ জনের ৬ জনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। অন্যান্য পদসমূহে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর হাইকোর্টে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে। এর মধ্যে ১ জন মাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। যতটুকু জানা গেছে, উচ্চতর আদালতে এ্যাটর্নী জেনারেল থেকে সহকারী এ্যাটর্নী জেনারেল পদে নিয়োগকৃত ২২৮ জনের মধ্যে ১ জন মাত্র ডেপুটি এ্যাটর্নী জেনারেল ও ১ জন সহকারী এ্যাটর্নী জেনারেল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। সরকারি কর্ম কমিশনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি।
আজকের এ সংবাদ সম্মেলন থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণের তীব্র নিন্দার পাশাপাশি অনতিবিলম্বে এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধের জন্যে সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। আমরা মনে করি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি এ ধরনের আচরণ সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে সংখ্যালঘুদের পর্যায়ক্রমিক নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ার একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল শ্লোগান ছিল ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’। এক্ষেত্রে সরকার মেধাকেই গুরুত্ব না দিয়ে কোটাকেই বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছে বলে আমরা মনে করি।
♦ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক সংবিধান সংস্কারে উদ্যোগ
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধান সংস্কারের জন্যে অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি গঠন করেছে। উক্ত কমিটি ইতোমধ্যে একটি খসড়া প্রস্তাব মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছেন। পত্রিকান্তরে জানতে পারলাম, এতে রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তনের প্রস্তাব দেয়া
হয়েছে বিশেষ করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এ সংস্কার কমিটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন প্রতিনিধিত্ব ছিল না বা সংস্কার কমিটির পক্ষ থেকে অংশীজন হিসেবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃবৃন্দের সাথে এ বিষয়ে কোন আলোচনাও করা হয়নি। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার জন্যে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক
ও ন্যায়বিচারভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে। স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে চার মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছিল। সংবিধান সংস্কার কমিটির পক্ষ থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’সহ তিন মৌলনীতি বাদ দেয়া এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ শব্দটিতে পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে বাদ দেয়া ধর্মীয় স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণের নামান্তর ও রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে যে সকল বৈষম্য বিদ্যমান তা অস্বীকার করা। সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের পৃষ্টপোষকতা করা। সকল ধর্মের জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্যে সরকারের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে তা থেকে রাষ্ট্রকে মুক্তি দেয়া।
সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে আমাদের যে প্রস্তাবনা রয়েছে তা আপনাদের মাধ্যমে আজকের এ সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরছি:
১. জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য বর্তমান সংবিধানে যে প্রস্তাবনা রয়েছে- ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎস্বর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে’। আমরা এ প্রস্তাবনা হুবহু বহাল রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করছি।
২. ২(ক) প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন। এই অনুচ্ছেদটি সংবিধানের মূল প্রস্তাবনার ‘সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত’ করার পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক এবং তা বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্বাকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছে। তাই ২(ক) অনুচ্ছেদটি সম্পূর্ণভাবে বাতিল করার প্রস্তাবনা আপনাদের মাধ্যমে আপামর দেশবাসীর সামনে উত্থাপন করছি।
৩. ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করার জন্যে সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নীতি বাস্তবায়নের জন্যে (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর বৈষম্য ও নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে উল্লেখ রয়েছে। উক্তরূপ ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’ হুবহু বহাল রাখার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করছি। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে যা আমাদের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি।
‘ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য’সম্বলিত সংবিধানের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ২৮(১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না, (২) রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন, (৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী ও পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না, (৪) নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্যে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবেনা। তাই ‘ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য’ সম্বলিত ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদ হুবহু বহাল রাখার পক্ষে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করছি এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য দূর করার জন্যে- ১) সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, ২) জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ও ৩) সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনা সরকার ও দেশবাসীর সামনে আপনাদের মাধ্যমে উত্থাপন করছি। কারণ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জীবনে ও সমাজে বিরাজমান বৈষম্য দূর করা এবং আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে এ প্রস্তাবনাগুলো বিবেচনায় রাখা অত্যাবশ্যক।
৪. বিগত সাত দশকের অব্যাহত নির্যাতন, নিপীড়ন, বৈষম্যের কারণে ধর্মীয সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ‘অগ্রসরমান জনগোষ্ঠী থেকে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী’তে পরিণত হওয়ায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর যথাযথ প্রতিনিধিত্ব সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করার লক্ষে বাংলাদেশে ৬০টি সংসদীয় আসন নির্ধারণ করে সংখ্যালঘুদের সরাসরি ভোটে সংখ্যালঘুদের জন্যে ৬০টি আসন সংরক্ষণের প্রস্তাবনা সরকার, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সহৃদয় বিবেচনার নিমিত্তে আজকের এ সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপন করছি।
♦ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
আপনারা অবগত আছেন যে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান (যেমন: বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, জাতীয় নির্বাচন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন ও জাতীয় তথ্য কমিশনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান)। বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এটা একটি বড় ধরনের বাধা, যা দূর করার নিমিত্তে এ মুহূর্তে পদক্ষেপ নেয়ার জন্যে সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। আমরা প্রস্তাব করছি, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে কমপেক্ষ ২০% ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হোক।
♦ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে হয়রানীমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী গত ৯ আগস্ট, ২০২৪ থেকে শুরু করা চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সম্মিলিতভাবে দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানায়। কোন কোন ক্ষেত্রে সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে তোলে। আমরা লক্ষ্য করছি, সমাজের এক বিশেষ গোষ্ঠী সারা দেশব্যাপী ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হয়রানীমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করে এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলাকে আমলে নিয়ে বেশ কয়েকজন নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে যারা বর্তমানে বিভিন্ন কারাগারে আটক রয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী, যিনি দীর্ঘদিন কারাভ্যন্তরে রয়েছেন। অনেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন। আমরা আরো লক্ষ্য করছি, স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ লাগিয়ে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাদেরকে হয়রানী ও কারাগারে পাঠাবার ব্যবস্থা করে সর্বশান্ত করার জোর অপ্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও চক্রান্তের সাথে যুক্ত অপরাধীরা বীরদর্পে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা আরো লক্ষ্য করছি যে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দের পক্ষে যারা আইনগত সহায়তা দিতে ইচ্ছুক তাদেরকেও বিশেষগোষ্ঠী সংঘবদ্ধভাবে বাঁধা দিচ্ছে। এমনকি কোথাও কোথাও তাদেরকে শারীরিকভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে, হচ্ছে। আমরা মনে করি, একজন মানুষ ও দেশের নাগরিক হিসেবে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আইনী সহায়তা পাওয়ার অধিকারও আজ হুমকির সম্মুখীন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্তসহ সারা দেশব্যাপী ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু অনেক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে
দায়েরকৃত সকল প্রকার হয়রানীমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হোক এবং চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ যে সকল নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে অনতিবিলম্বে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হোক। আমরা জোর গলায় বলতে পারি, বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সবসময়ই শান্তির পক্ষে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে এবং রাখছে।
♦ দলিত ও ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠীর জন্যে রাষ্ট্রের বিশেষ উদ্যোগ
সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি, দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা সমতল ও পাহাড়ের নানা গোত্রের আদিবাসী জনগোষ্ঠী, চা-শ্রমিক, হরিজন, ঋষি, রাজবংশী সম্প্রদায়ের জন্যে আলাদা কোন কমিশন গঠন করা হয়নি। আমরা মনে করি, দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার জন্যে রাষ্ট্র ও সরকারের বিশেষ উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন এবং তা সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
♦ ৮ দফা দাবির বাস্তবায়ন
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষায় অনতিবিলম্বে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের দাবি নি¤েœাল্লখিত ৮ দফা অনতিবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে যেসব জায়গায় উক্ত ৮দফা বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে, সংস্কার কমিশন ও সরকার সে ব্যাপারে ভূমিকা রাখবেন বলে আমরা আশা রাখি।
১. সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা;
২. জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন করা;
৩. অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ প্রয়োগে যাবতীয় আমলাতান্ত্রিক বাধা অপসারণ করে ট্রাইব্যুনালের রায়ের আলোকে জমির মালিকানা ও দখল ভুক্তভোগীদের বরাবরে অনতিবিলম্বে প্রত্যর্পণ করা;
৪. বিগত সাত দশকের অব্যাহত নির্যাতন, নিপীড়ন, বৈষম্যের কারণে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ‘অগ্রসরমান
জনগোষ্ঠী থেকে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী’তে পরিণত হওয়ায় বিদ্যমান সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদের আলোকে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর যথাযথ প্রতিনিধিত্ব সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করার লক্ষে বাংলাদেশে ৬০টি সংসদীয় আসন নির্ধারণ করে সংখ্যালঘুদের সরাসরি ভোটে সংখ্যালঘুদের জন্যে ৬০টি আসন সংরক্ষণ করা;
৫. দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণে আইন প্রণয়ন করা;
৬. বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন করা;
৭. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের যথাযথভাবে কার্যকর করা;
৮. সকল সংখ্যালঘু ধর্মসম্প্রদায়ের ধর্ম পালনে অধিকতর উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান সরকারি ছুটিসমূহের অতিরিক্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দূর্গাপূজায় অষ্টমী থেকে দশমী-এ ৩ দিন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমায় ১ দিন ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ইস্টার সানডে’তে ১ দিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করা।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণের জীবনের চলমান করুণ পরিস্থিতি ও তাদের আকাঙ্খাসমূহ আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসী, সকল রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং বর্তমান সরকারের কাছে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের প্রতি আমাদের আবেদন বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় জনমত গড়ে তোলাসহ নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন এবং তাদের রাজনৈতিক সম্পাদ্য কার্যাবলীতে অন্তর্ভুক্ত করবেন।
সবশেষে বলতে চাই, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা আজ ঐক্যবদ্ধ- সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে, অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এবং অস্তিত্ব রক্ষায়।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
দীর্ঘ সময় ধরে আপনারা আমাদের বক্তব্য শুনেছেন। আমরা আশা করবো আপনারা আপনাদের নিজ নিজ গণমাধ্যমে আমাদের বক্তব্যকে তুলে ধরে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের চলমান বৈষম্যবিরোধী মানবাধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সর্বাত্মক সহায়তা করবেন।
আপনাদের সু-স্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন কামনা করছি।
আন্তরিক ধন্যবাদান্তে-
(ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক)
(ঊষাতন তালুকদার)
(নির্মল রোজারিও)
[সভাপতিত্রয়]
(মনীন্দ্র কুমার নাথ)
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক
ও
যুগ্ম-সমন্বয়ক
ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চা
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ