রোকেয়া কবীর: একটি প্রশ্ন দিয়ে এই লেখা শুরু করতে চাই। আমি যদি ঠিক বুঝে থাকি, ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামের অর্থ দাঁড়ায় ইসলামের হেফাজতকারী। যদি তাই হয়, তাহলে আমার প্রশ্ন হলো, ইসলামের হেফাজত করার জন্য কোনো সংগঠন বা ব্যক্তি দায়িত্ব নিতে পারে কি না? যেখানে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা জানেন যে তাদের জান, মাল, ইজ্জত, বিশ্বাস সবকিছুর হেফাজত করেন স্বয়ং আল্লাহ। আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান, তার অগোচরে কিছুই হওয়ার জো নেই।
সেজন্য বলা হয়, ইসলামে আল্লাহ ও মানুষের মাঝখানে মধ্যস্থতাকারীর কোনো স্থান বা প্রয়োজন নেই। সুতরাং ‘ইসলামের হেফাজত’ করার কথা কেউ বলতে পারে কি না?
আমরা ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি, হিন্দুধর্মের বর্ণবাদী প্রথায় নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ পড়ার কোনো অধিকার ছিল না। তেমনি খ্রিস্টান ধর্মের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল আগে শুধু ল্যাটিন ভাষায় লেখা হতো। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে অনুসারীরা নিজ নিজ ভাষায় বাইবেল পড়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে তাদের ঈশ্বর ও খ্রিস্টান ধর্মের বিশ্বাসীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যাজক সম্প্রদায়ের যে দাপট ছিল তা কমে আসে।
এবার আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের দিকে যাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল রাজনৈতিক বিশ্বাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশে কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চলবে না বা ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করা যাবে না। অর্থাৎ ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক রাখতে হবে।
তাহলে ১৯৭৫-এর পর ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার ও পুঁজি করে যে ব্যবসা শুরু হয়েছিল তা এখনো কেন চলতে দেওয়া হচ্ছে? কেন ইসলামকে পুঁজি করে দেশে এতগুলো রাজনৈতিক দল ও সংগঠন তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছে?
সোনারগাঁয়ের রিসোর্টে মাওলানা মামুনুল হক যে কাজটি করেছেন, ইসলামকে পুঁজি করা তার মতো ব্যক্তিদের এ ধরনের কার্যকলাপ নতুন নয়। গত কয়েক বছরের পত্রিকার রিপোর্টে তার চিত্র স্পষ্ট। মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল, শিক্ষক, এতিমখানার হুজুর প্রমুখের যৌন লালসার আসল পরিচয় সেসব রিপোর্টেই পাওয়া যায়। আমরা আমাদের গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদিতে অনেক ভ- পীর, মৌলভী, ধর্মগুরুর চরিত্র পাই। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এদেরই বলেছিলেন “মৌ-লোভী যত মৌলভী”।
গত শতকের ৭০ ও ৮০-র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রেডিও, টেলিভিশনের বিভিন্ন খল চরিত্রে আমরা টুপি ছাড়া চেয়ারম্যান, মাতব্বরের পাশাপাশি অনেক টুপিওয়ালাও দেখেছি। এরশাদের আমলে এই সমস্ত মৌলবাদীদের আবদারে ফরমান জারি হলো, টেলিভিশনে কোনো টুপিওয়ালা দুর্বৃত্তের চরিত্র দেখানো যাবে না। এদের চরিত্র এখনো মূলত একই রয়ে গেছে। তাদের ওয়াজের বেশিরভাগই ‘নারী’কেন্দ্রিক নারী ‘শয়তানের চর’, ‘দোজখের রাস্তার পথপ্রদর্শক’, সুতরাং নারীকে পর্দার আড়ালে রাখতে হবে। তাদের সম্পত্তিতে সমান অধিকার দেওয়া যাবে না।
আমাদের ছোটবেলায় আমরা ওয়াজে শুনেছি ইসলামে ছবি তোলা নিষেধ, বিজ্ঞান ইসলামবিরুদ্ধ তাই মসজিদে মাইক লাগানো যাবে না ইত্যাদি। আর নারী সম্পর্কে ফতোয়ার তো সীমা-পরিসীমা নেই। যেমন স্বামীর পায়ের তলায় স্ত্রীর বেহেশত, স্বামীর নাম মুখে আনা যাবে না ছাড়াও কিছুদিন আগ পর্যন্ত ছিল ‘হিল্লা’ বিয়ে নামক এক ব্যবস্থা। এসব হিল্লা বিয়েতে ‘স্বামী’ হতো অবশ্যই গ্রামের মাতব্বর গোছের কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা কোনো ধর্ম ব্যবসায়ী।
এ বিষয়ে মামুনুল হকের মতো মাওলানারা যে এক ধাপ এগিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। তারা এখন হিল্লার ধার ধারেন না, কারণ তারা রিসোর্টে যান। তারা এখন ওয়াজ করতে যেতে হেলিকপ্টারে চড়েন। কাজেই রিসোর্টে যাওয়া তো তাদের কাছে রীতিমতো ডাল-ভাত।
তবে তার কথায় একটি গূঢ় সত্য বের হয়ে এসেছে। তিনি লিখেছেন, একটি অসহায় মেয়েকে হেফাজত বা তার অভিভাবকত্ব করতে গিয়েছিলেন ইত্যাদি। হেফাজত বা অভিভাবকত্ব করার এই সুযোগটি টিকিয়ে রাখবার জন্যই হেফাজতওয়ালা ধর্মব্যবসায়ীরাসহ সমাজের অনেক লোক সমানাধিকার ও সমমর্যাদা নিয়ে নারীরা স্বাবলম্বী বা রাষ্ট্রের সমান নাগরিক হয়ে উঠুক, তা চায় না।
তা ছাড়া, নারী স্বাবলম্বী হয়ে সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের সেবা ও শ্রম বিনা পারিশ্রমিকে উপভোগ করার যে সুযোগ তা অনেকেই হারাবেন।
এমনকি যাদের হারানোর কিছু নেই, সেই শ্রমিক বা রাস্তায় যে ভিক্ষা করে সেও ঘরে ফিরে ধমকের সুরে তার স্ত্রীকে বলতে পারে, ‘এই এক বদনা পানি দে, আমি হাতমুখ ধোব’। এই ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগটাই বা কম কী! নারীর বিরুদ্ধে একাট্টা হওয়ার এই স্বার্থ, তা যত সস্তাই হোক, ছাড়তে চায় কে? এটাই মামুনুল হকদের বড় পুঁজি।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ও চেতনার অনুসারী বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের মতো তালেবানি রাজ্যে পরিণত করতে চাওয়া হেফাজতওয়ালাদের সম্পর্কে যে পলিসি নিয়ে চলেছে, তার পরিণতি কী তা সবাই দেখছেন এবং এ বিষয়ে অনেকেই লিখেছেন ও লিখছেন।
সুখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছ থেকে ধার করে বলতে চাই, তারা কি এই তালেবানিদের সম্পর্কে এই ভাবছেন ‘আমি আর কাকা একা, চোর আর লাঠি দোকা’? তা না হলে তালেবান উৎপাদনকারী হেফাজতিদের লাঠিয়াল সরবরাহের উৎস কওমি মদ্রাসার লাগাম টেনে না ধরে তাদের ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমগোত্রীয় করার এই যে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তার পুনর্বিবেচনা জরুরি। বরং ‘গরিবদের জন্য মাদ্রাসা বা টোল’ এই মনোজগৎ থেকে বেরিয়ে তাদের জন্য কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা এবং দশম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমি মনে করি সরকার এবং সকল প্রগতিমনা রাজনৈতিক শক্তি ও জনগোষ্ঠী, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাস্তায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তাদের সক্রিয় হওয়ার জন্য এক ঘণ্টাধ্বনি।
লেখক মুক্তিযোদ্ধা ও নারীনেত্রী। নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ
স্বীকৃতি: প্রতিবেদনটি [এই লিংক থেকে ] গুগল নিউজ ফিডের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের ওয়েবসাইটে পোস্ট হয়েছে। মাইনোরিটি ওয়াচ এই লেখা সম্পাদনা করেনি। এই লেখার সকল তথ্য, উপাত্ত, দায়িত্ব এবং কৃতিত্ব এর রচয়িতার।